ঢাকা,শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ঈদগাঁওতে চিকিৎসা সেবা ঔষুধ কোম্পানীর হাতে জিম্মি !

সেলিম উদ্দীন, ঈদগাঁও কক্সবাজার প্রতিনিধি:

কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁওতে ঔষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের কাছে জিম্মি চিকিৎসা সেবা। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার কিংবা যে কোন ডাক্তারের চেম্বারের সামনে প্রতিনিয়ত ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের হাতে নাজেহাল হতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। লম্বা সিরিয়াল শেষে যখন রোগীরা ডাক্তার দেখিয়ে বের হয় তখনই প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানাটানি শুরু করেন বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। তাদের কোম্পানির ঔষধ লিখেছে কিনা এজন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলায়। এতে করে বাদ যায় না মূমূর্ষ রোগীও। গতকাল মঙলবার এমনতর চিত্র দেখা গেছে।

সরজমিন ঈদগাঁও’র বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের নিজেদের অবস্থান কোম্পানীর কাছে তুলে ধরতে রোগীর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলে নিচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজারের প্রত্যেকটি হাসপাতাল, ক্লিনিকে ডাক্তার চেম্বারে থাকা পর্যন্ত রোগী বেরিয়ে আসলে স্বজনদের রিপ্রেজেন্টেটিভকে ব্যবস্থাপত্র দেখাতে হচ্ছে। এতে করে রোগী ও তার স্বজনরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। রোগীদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাদের কোম্পানির ঔষুধ লেখা আছে কি না তা দেখতে রোগীদের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তারা।

গতকাল মঙলবার দুপুর পর্যন্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ঔষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভদের মহড়া। জালালাবাদ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায় সব সময় ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দাড়িয়ে প্রেসক্রিপশনের ছবি নিচ্ছেন বিভিন্ন কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভরা। মনে হচ্ছে প্রেসক্রিপশনের ছবি না নিতে পারলে চাকুরী থাকবে না। হাসপাতালের ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দল বেধে রিপ্রেজেনটেটিভরা রোগীর প্রেসক্রিপশনের অপেক্ষা করেন। তারা দলবেঁধে প্রতিটি ডাক্তারের চেম্বারের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে এবং ডাক্তারের সাথে দেখা করে কোম্পানির ঔষুধ স্যাম্পলসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী ধরিয়ে দেন।

খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, ঔষুধ কোম্পানীগুলোর মধ্যে মার্কেটিং প্রমোশনের নামে প্রতিদিন চলছে অসুস্থ বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা। ছোট বড় প্রায় সব কোম্পানী নিজ প্রতিষ্ঠানের ঔষুধ বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে মার্কেটিং প্রমোশনের নামে ডাক্তারদের পিছনে কোম্পানির প্রতিনিধি লাগিয়ে রোগীর ব্যবস্থাপত্রে কোন ঔষধ লেখেছেন ডাক্তার তা খতিয়ে দেখছেন। ব্যবস্থাপত্র দেখানোকে কেন্দ্র করে অনেক রোগীর স্বজন বিক্রয় প্রতিনিধিদের হাতে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনায়ও ঘটেছে।

ঈদগাহ মেডিকেল সেন্টারে জনৈক ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলীর আমিনুল হক নামের এক রোগী বলেন, সকাল থেকে হাসপাতালে আসছি। দুই ঘন্টা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকার পর ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার দেখিয়ে বের হতেই প্রেসক্রিপশনের ছবি নিতে আমাকে ঘিরে ধরেছে কোম্পানির প্রতিনিধিরা । তিনি বলেন তাদের কোম্পানির ঔষধ লিখেছে কিনা এজন্য এক এক করে সবাই আমার প্রেসক্রিপশনের ছবি নিয়েছেন। আমি অসুস্থ তবুও এরা জোর করে আমার কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন ছিনিয়ে নেয়। এতে আমি খুব বিব্রত বোধ করছি।

জালালাবাদ মোহনভিলা গ্রামের পপি আক্তার নামের এক সাধারণ রোগীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, জালালাবাদ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর চেয়ে ঔষধ কোম্পানির লোকজন বেশি দেখা যায়। তারা আমার প্রেসক্রিপশনের ছবি নিছে। তিনি বলেন যখনই ডাক্তার দেখাই ঔষধ কোম্পানির লোকজন ছবি তুলে। কি কারনে তুলে জানি না। এরকম প্রায় সময় ঘটে। আপত্তি জানালেও কোন কাজ হয় না।

একটি নির্ভর যোগ্য সূত্র জানায়, ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের চাকরির পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকার ঔষুধ বিক্রি করতে বাধ্যতামূলক টার্গেট রয়েছে কোম্পানিগুলোর। এ কারণে বিক্রয় প্রতিনিধিরা চাকরি বাঁচাতে টার্গেট পূরণ করতে নানা ছলচাতুরি ও প্রলোভন দেখিয়ে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় সব রকমের ঔষুধ ডাক্তার ম্যানেজ করে বিক্রি করছে। ঔষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা টার্গেট পূরণ করতে ডাক্তার ও প্রতিষ্ঠান ভেদে কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে কলম, প্যাড, চাবির রিং থেকে শুরু করে টিভি-ফ্রিজ, আসবাবপত্র সরবরাহও করে থাকে।

বিশ্বস্থ সূত্রে আরো জানা গেছে, অখ্যাত ঔষুধ বাজারজাত করার জন্যে ঔষুধ কোম্পানির এসব রিপ্রেজেন্টেটিভ একজন ডাক্তারকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র কোম্পানির পক্ষ থেকে উপহার দিয়ে থাকে। তাছাড়া যে ডাক্তার যে কোম্পানির অখ্যাত ঔষুধগুলো বেশি প্রেসক্রাইব করেন সেই ডাক্তারের জন্য মাস শেষে প্রচুর স্যাম্পল ঔষুধ এবং নগদ টাকা-পয়সা উপহার দিয়ে থাকেন। ফলে বেশিরভাগ ডাক্তার বলা যায় এক প্রকার জিম্মিই হয়ে আছেন এসব ঔষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে।

নাম না প্রকাশের শর্তে ঈদগাঁও বাজারের বেশকটি ফার্মেসী ব্যবসায়ী জানান, ঔষুধ কোম্পানি গুলোর আগ্রাসী মার্কেটিং নীতির ফলে অপ্রয়োজনীয় ঔষধের ব্যবহার বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি ঔষুধ বাজারজাতকরণ নীতিমালা থাকলেও তা কেউই মানে না। ফলে অসাধু ও অর্থলোভী ডাক্তার, হাতুড়ে ডাক্তার ও ফার্মাসিষ্টদের ফাঁদে পড়ে অশিক্ষিত ও দরিদ্র রোগীরা ভেজাল ও নিম্নমানের ঔষধ সেবন করে প্রতারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এ বিষয়ে একাধিক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসাররা জানান, হাসপাতালে অনেক রিপ্রেজেন্টিভরা আসে ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলতে। তাদের কোম্পানীদের ঔষূধ ডাঃ লিখেছে কি না সেটা দেখার জন্য। আমরা তাদের বেশির ভাগ সময়ই আসতে নিষেধ করি।

পাঠকের মতামত: